সলিম জাহানের অন্যতম দরদী নেতা এবং মালয়শিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডাঃ মাহাথির বিন মুহম্মদ গতকাল (শুক্রবার) এক সংবাদ সম্মেলনে আবারও নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এখনো দলটির নাম প্রকাশ না করলেও তা মালয়ভিত্তিক হবে বলে জানান তিনি।

বর্তমানে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়েছেন তাঁরই ছেলে দাতুক সেরি মুখরিজ বিন মাহাথির। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে ২০১৮ সালে নতুন দল গঠন করে ক্ষমতায় আসা মাহাথির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে, প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে চমক দেখিয়ে দেন!

এরপর মাহাথিরের দলের মন্ত্রী মহিউদ্দীন ইয়াসিন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের আগে তাঁর গঠিত রাজনৈতিক দল বেরসাতু থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পদত্যাগ পত্র চ্যালেঞ্জ করলেও আর ফিরে যেতে পারেননি দলের চেয়ারম্যানের পদে।শেষ পর্যন্ত নতুন রাজনৈতিক দল গঠ

নের ঘোষণা দিলেন ৯৬ বছর বয়সে মাহাথির। তাঁকে মালয়েশিয়ার রাজনীতির গুরু বলে স্বীকার করেন সেদেশের রাজনৈতিক নেতারা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা মাহাথির সাবেক দল বারিশান ন্যাশনাল থেকে পদত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের দুর্নীতির অভিযোগে। এরপর তাঁর ক্ষমতায় আসার পরপরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়।

রাজনীতিতে মাহাথিরের হাতেখড়ি ১৯৪৬ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন উত্তাল মালয়েশিয়া। তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও) যোগ দেন তিনি। ঐ দলের মূল আদর্শ ছিলো জাতীয়তাবাদ।

ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন মাহাথির। এরপর জন্মভূমি কেদাহ রাজ্যে ৭ বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। ধীরে ধীরে তিনি ‘ডক্টর এম’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

ইউএমএনও দলের হয়ে ১৯৬৪ সালে মালয়েশিয়ার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তবে ১৯৬৯ সালে ঘটে ছন্দপতন। দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে সংসদে আসন হারান তিনি।

মালয় সম্প্রদায়কে অবহেলার অভিযোগ তুলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেংকু আব্দুলররহমানের কাছে খোলা চিঠি লিখেছিলেন মাহাথির। এতেই ক্ষমতাসীন দলের রোষের মুখে পড়েন তিনি।
মালয়েশিয়ায় কী ঘটছে, তা বুঝতে ফিরে যেতে হবে ১৯৯৮ সালে – যখন মাহাথির তার প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখন সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর আগে আনোয়ার ইব্রাহিম তাঁর ডেপুটি ছিলেন। আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার এক বছর আগে ২০০৩ সালে মাহাথির পদত্যাগ করেন। ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মাঝে অনেক ঘটনা ঘটেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল সরকারকে বিদায় করতে মাহাথির সব বিরোধী দলকে নিয়ে এক মহা ঐক্যজোট গঠন করেন। সে জোটের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বিরোধী পাকাতান হারপানের নেতৃত্ব দেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে জোট জয় পায়।

জোট গঠনের আগে মাহাথিরের সঙ্গে আনোয়ারের চুক্তি হয় যে, পাকাতান জয়ী হলে পরবর্তী সরকারের দু বছর নেতৃত্ব দেবেন মাহাথিরদ। এরপর আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব হস্তান্তর করবেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি মোতাবেক, আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে আগ্রহী ছিলেন না তিনি, বরং বিজয়ী হয়ে তিনি সেরি ডাঃ ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইলকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করেন।

পরিশেষে মাহাথির পদত্যাগ করলেও কথা রাখেননি। তিনি শুধু পদত্যাগই করেননি; তার দল সরকার থেকেও পদত্যাগ করে।
দৃশ্যত, পাকাতান হারপান জোটের প্রধান দল পিকেআরের প্রধান আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে মালয়েশিয়ায়।

এক সময়ের নিজের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী ও সহকর্মী আনোয়ার ইব্রাহিমকে জেলে দিয়ে আবার তারই দলের একজন হয়ে পাকাতান হারপান নামক জোট বেঁধে মাহাথিরের নির্বাচনে বিজয় লাভ ও সরকার গঠন রাজনৈতিক অঙ্গনের এক বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো।

২০১৮ সালের শেষের দিকের সে ঘটনায় বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে সৌহার্দ্য, সহনশীলতা এবং গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধির দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলো। চলতি বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারী আচমকা পদত্যাগের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে আলোড়ন তুলেছেন মাহাথির।
ইতিমধ্যে কয়েকটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাককে ১২ বছরের জেল দিয়েছে দেশটির আদালত। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকও ছিলেন মাহাথিরের শিষ্য।

এদিকে, মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে নির্বাচন দিতে পারে বলে আলোচনা চলছে দেশটিতে। মাহথিরের নতুন দল আগামী নির্বাচনে সরকার গঠন করতে পারে কিনা, তা নিয়ে দেশটিতে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

সূত্র: যুগান্তর।