কে এই হামাদ হাসসাব! এক অজানা কৌতুহল নিয়ে নামটির উপর ক্লিক করে বসেন ইয়াসমিন। নাহ, সাইটে নামটি থাকলেও, সেখানে আর কোনো তথ্যই যে দেয়া নেই। টাইটানিক যাত্রীদের জীবনী সংক্রান্ত অনলাইন বিশ্বকোষ ‘এনসাইক্লোপেডিয়া টাইটানিকা’ সাইটে এতোক্ষণ হামাদ হাসসাবের নামটি দেখতে দেখতে রীতিমতো এই লোকটির ব্যাপারে জানার নেশা পেয়ে বসলো মিশরীয় তরুণ সাংবাদিক ইয়াসমিন সাদকে। কিন্তু ততোদিনে জাহাজডুবির শতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় এমন একজন ব্যক্তির পরিচয় অন্বেষণ করা কতোটা ঝক্কি-ঝামেলার, তা জেনেও ইয়াসমিন তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন সেসময়কার পত্রিকাগুলোর প্রতিটি পাতা। যোগাযোগ করলেন মিশরীয় নাগরিকদের আর্কাইভসহ বিভিন্ন এজেন্সীতে। একটাই আশা! যদি কোনোভাবে হামাদ হাসসাবের খোঁজ মেলে? কিন্তু না, দীর্ঘ তিন বছর ধরে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন আর কোনো তথ্য মিললো না, ইয়াসমিন অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই একটি মিশরীয় জাতীয় দৈনিকে লিখলেন তার এই ব্যর্থ অনুসন্ধানের খুঁটিনাটি।
হামাদ হাসসাবের নাতিদের কাছে থাকা তার একমাত্র ছবি Image Source: titanic.fandom.com/wiki/Hammad_Hassab
কী অদ্ভূত ব্যাপার! কয়েক সপ্তাহ পরই এই হামাদ হাসসাবের একজন নিকটাত্মীয় যোগাযোগ করলেন ইয়াসমিন সাদের সাথে। প্রথমে কিছুটা অনীহা দেখালেও ধীরে ধীরে হামাদের দুই নাতি – মোহাম্মদ আম্মার আর সেরাগ আল-দ্বীন – ইয়াসমিনকে জানাতে শুরু করলেন দাদার অজানা সব তথ্য। ১৮৮৫ সালে জন্ম নেয়া হামাদ হাসসাব বুরেইক মিশরের রাজধানী আল-ক্বাহিরাতে (কায়রো) ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করতেন। আরবীর পাশাপাশি জানতেন ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান। একবার যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ধনকুবের হেনরী হার্পার স্বস্ত্রীক কায়রো বেড়াতে এলে হামাদ তাদের গাইড হিসেবে শহরটি ঘুরিয়ে দেখান। এতে হার্পার ও তার স্ত্রী মিরা খুশি হয়ে হামাদকে আমন্ত্রণ জানালেন, তাদের অতিথি হিসেবে বিলাসবহুল টাইটানিকে চড়ে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য। হামাদ রাজি থাকায়, তার টিকেটের ব্যবস্থাও হয়ে গেলো। যে-সে শ্রেণীর টিকেট নয়, এক্কেবারে প্রথম-শ্রেণীর টিকেট! অথচ, টাইটানিকের প্রায় সকল আরব যাত্রীরা ছিলো জাহাজের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী।
যথারীতি টাইটানিকে চড়ে, হার্পারের পারিবারিক অতিথি হিসেবেই যাত্রা করলেন হামাদ। হার্পার-পরিবারকে সময় দেয়ার পাশাপাশি হামাদ মাঝে মাঝে টাইটানিকের ক্যাপ্টেনের পাশে দাঁড়িয়ে বিশালাকার এই প্রমোদতরী চালানোর কৌতুহল মেটাতেন। মনোযোগ দিয়ে শুনতেন রেডিওতে ভেসে আসা খবরা-খবর। টাইটানিকের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার আগের দিন, বিপরীত দিক থেকে আসা এক জাহাজ থেকে পাঠানো এমনই একটি রেডিও বার্তা শুনতে পেলেন হামাদ। ঐ রেডিও বার্তায় টাইটানিককে সতর্ক করা হয়েছিলো এই বলে যে, কয়েক কিলোমিটার দূরেই আইসবার্গ রয়েছে। কিন্তু এ বার্তা তোয়াক্কা না করে, টাইটানিক-ক্যাপ্টেন এগিয়ে চললেন। অবশেষে এলো সেই বেদনাময় মুহূর্ত! আইসবার্গের ধাক্কায় জাহাজ নড়ে উঠলো, আর তিনি শুনতে পেলেন, জাহাজের কর্মচারীদের একজন বলছে, জাহাজটি নিশ্চিতভাবেই ডুবে যাবে! এ কথা শোনামাত্রই পড়িমরি করে হামাদ দৌড়ে গেলেন তার আরব বন্ধুদের সতর্ক করতে, যারা ছিলো জাহাজের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী। এরপর তিনি হার্পার-পরিবারের সবাইকেই উঠালেন ৩নং জীবনতরীতে (লাইফবোট)। শেষে নিজেও তাতে উঠলেন এবং লোকজনের ভিড় ঠেকাতে জীবনতরীর দড়ি দিলেন কেটে। পরে দেখা গেলো, জীবনতরীটির ধারণক্ষমতার অর্ধেকও পূরণ হয়নি।
আইসবার্গ, যার সাথে ধাক্কা লেগে টাইটানিক ডুবে যায়। ছবিটি ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল সকালে তুলা হয়। Image Source: https://en.wikipedia.org/wiki/RMS_Titanic
মাত্র ৩২ জন যাত্রী নিয়ে জীবনতরীটিকে যখন দূরে ঠেলে নেয়া হচ্ছিলো, হামাদ শুনতে পেলেন, বাঁচার আশায় থাকা শত শত যাত্রীর আর্তনাদ আর সেসব যুবকের গান ও গিটারের তান, যারা বাঁচার আশা নেই জেনে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু উপভোগ করছিলো। হামাদ সাক্ষী হয়ে থাকলেন বিরহের প্রতীক এক প্রমোদতরীর প্রথম যাত্রাতেই মর্মান্তিক সাগরডুবির! এরপর হামাদ ও হার্পারদের ৩ দিন কেটে গেলো আটলান্টিকের বুকেই, জীবনতরীতে ভেসে ভেসে, অন্য জাহাজ কর্তৃক উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত।
এদিকে, হামাদ তার পরিবারকে একটি পোস্টকার্ডের মাধ্যমে জানালেন, তিনি বেঁচে আছেন, যা দুর্ঘটনার চার দিন পর কায়রোতে তার পরিবারের কাছে পৌঁছেছিলো। কিন্তু এরপর তিনটি বছর হামাদ হাসসাবের কোনো খোঁজই মিললো না। এ তিনটি বছর তিনি কোথায় ছিলেন বা কী করেছেন, তার পরিবারের কাছে এখনও তা অজানা। দীর্ঘ ৩ বছর পর সহসাই হামাদ উদয় হলেন কায়রোয়। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে শুরু করলেন স্বস্তির জীবন। তবে এরপরও দীর্ঘদিন তিনি কোনো নৌযাত্রায় বের হননি। টাইটানিকের মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আবারও ঘটার শঙ্কায় অবসাদগ্রস্ত থাকতেন সবসময়। ১৮৬৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রোগমুক্ত একটি জীবন কাটান হামাদ। সুযোগ পেলেই পরিবারকে সবাইকে টাইটানিকের কাহিনী শোনাতেন বারবার। পরিবারের সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো সেসব কাহিনী, যার বাস্তবতা তার নাতিদের মুখে শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন ইয়াসমিন সাদ। ইয়াসমিনের নিরন্তর আগ্রহ ও প্রচেষ্টার কারণেই, হামাদ হাসসাব বুরেইকের পরিচয় ও রোমাঞ্চকর কাহিনী আমাদের সামনে উঠে এসেছে। যে এনসাইক্লোপেডিয়া টাইটানিকা’য় হামাদ হাসসাবের নামটি ছিলো তথ্য-পরিচয়হীন, তা এখন হয়ে উঠেছে টাইটানিকের একমাত্র জীবিত মিশরীয় মুসলিমের চাঞ্চল্যকর বৃত্তান্তে পূর্ণ। আর কোনো কল্পনা নয়। টাইটানিক ডুবির শত বছর পর হলেও, বাস্তবতা পেয়েছে এই মিশরীয় যাত্রীর কাহিনী।
প্রিয় পাঠক, ‘দিন রাত্রি’তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- ‘দিনরাত্রি’তে আপনিও লিখুন