পরিচয়ঃ আবু বকর মোহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাযি বা আল-রাযি।
জন্মঃ ৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের তেহরানে জন্ম গ্রহণ করেন।
আগ্রহঃ রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র
অবদানঃ তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান, আল-কেমি, পদার্থবিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর ১৮৪টির বেশি বই লিখেছেন। তিনি সালফিউরিক এসিড আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন, ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রথম চিকিৎসক, যিনি হাম এবং গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর আগে দুটো রোগকে একই ভাবা হতো। হাম এবং গুটিবসন্ত সম্পর্কিত তার পর্যবেক্ষণ স্থান পেয়েছে তার ‘আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ’ গ্রন্থে।
আবু বকর মোহাম্মাদ ইবন যাকারিয়া আল রাযি বা আল-রাযি। Image Source: alchetron.com/Muhammad-ibn-Zakariya-al-Razi
চিকিৎসক হিসেবে আল রাযি অতুলনীয় নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার অবদান বিবেচনা করলে তাকে তুলনা করা যায় শুধু তার এক শতাব্দী পর জন্ম নেয়া চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনার সাথে। অনেক বিশেষজ্ঞ আল রাযিকে মধ্যযুগের সেরা চিকিৎসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাকে সেসময়ের সবচেয়ে সৃজনশীল লেখক বলেও মানা হয়। তিনি পেডিয়াট্রিকস, অপথ্যালমোলজি, নিউরোসার্জারি, সংক্রামক রোগ সহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর অনেকগুলো ভলিউমের ১০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। অনুবাদের বদৌলতে তার চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থাবলী এবং ধ্যানধারণা মধ্যযুগের ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদ্যাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল ।
আল রাযী চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈতিকতা নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি সেসময়ে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুয়া ডাক্তারদের দমন করেন। একইসাথে তিনি এটাও বলে গেছেন যে, উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের কাছেও সব রোগের নিরাময় নাও থাকতে পারে, এটা এক কথায় অসম্ভব। তবে তিনি চিকিৎসকদের আধুনিক জ্ঞান এবং নতুন নতুন তথ্যে সমৃদ্ধ হতে বলেছেন।
তিনি গরীব, অসহায় লোকজন, মুসাফিরদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পুস্তিকা রচনা করেন, যাতে করে তারা ডাক্তার কাছে না থাকলেও নিজেদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবশ্য তার ধারণা সমসাময়িক চিকিৎসকদের মতোই ছিল। তিনি মনে করতেন, শয়তানের প্রভাবেই মানসিক রোগ হয়ে থাকে। তবে তিনি এও বলেছেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দোষ, তাই রোগী চিকিৎসা ও যত্নের দাবী রাখে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহুবিধ মূল্যবান অবদানের জন্য তাকে ‘চিকিৎসকদের চিকিৎসক’ বলা হয়।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ আল রাযির রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে-
‘আল কিতাব আল হাওয়ি’,
‘দ্য ভার্চুয়াস লাইফ’,
‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’,
‘আল মানসুরি’ প্রভৃতি।
২৩টি ভলিউমে রচিত ‘আল কিতাব আল হাওয়ি’ গাইনোকলজি, অবেস্ট্রিকস এবং অপথ্যালমিক সার্জারির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। নয়টি ভলিউমে রচিত ‘দ্য ভার্চুয়াস লাইফ’ বইটিতে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এবং প্লেটোর কাজ সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্টিশীল ধারণা দেন। এই বইটিতে আল রাযি তার বিভিন্ন বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান, নানারকম রোগ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, তার রাখা সমস্ত নোটকে একত্রিত করেছেন। শুধুমাত্র এই বইটির জন্য অনেক পণ্ডিত তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বিবেচনা করেন। বইটি ইউরোপে ‘The large comprehensive’ বা ‘Continens Liber’ নামে পরিচিত।
আল – রাযির বিখ্যাত একটি বই। Image Source: sites.google.com/site/knowingandinspired/al-razi
আল রাযি রচিত আরেকটি যুগান্তকারী গ্রন্থ হচ্ছে ‘Doubts about Galen’। এই বইটিতে তিনি গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেনের অনেক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তার পর্যবেক্ষণের সাথে গ্যালেনের অনেক দাবীই সাংঘর্ষিক ছিল। এমনকি গ্যালেন জ্বরের যে লক্ষণের কথা উল্লেখ করে গেছেন, আল রাযি জ্বরের রোগীর সাথে তারও কোনো মিল পাননি। আল রাযির ‘The Diseases of Children’ বইটি পেডিয়াট্রিকসকে চিকিৎসাবিদ্যার স্বতন্ত্র একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তার রচিত বেশ কিছু বই পাশ্চাত্যের চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো।
মৃত্যুঃ তিনি ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।