গরু, মহিষ, উট, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া— এগুলোর বাইরে কিছু কোরবানি দেওয়া হয় কি না জানি না। যদি হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও ইসমাইল (আ:) এর সেই ঘটনার পর থেকে পশু কোরবানির রীতি চালু হয়ে থাকে, তাহলে এই রীতির বয়স মোটামুটি ৪ হাজার বছর। এই চার হাজার বছর ধরে ‘আল্লাহ’য় বিশ্বাসীরা গরু, মহিষ, উট, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া কোরবানি করে আসতেছে। কিন্তু এতদিনেও এইসব প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এখনো প্রচুর পরিমাণে গরু, মহিষ, উট, দুম্বা, ছাগল, ভেড়া পাওয়া যায়।
প্রাণীর মাংস রপ্তানিতে শীর্ষে অবস্থান করছে ব্রাজিল ও ভারত। ২০১৮ সালে ডেইলি হান্ট পত্রিকার বরাতে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ব্রাজিলকে হটিয়ে বিশ্বের শীর্ষ গরুর মাংস রপ্তানিকারক দেশ এখন ভারত। এই দুটি দেশই অমুসলিম দেশ। এমনকি শোনা যায় যে, ব্রাজিলে নাকি আজানও নিষিদ্ধ! তো, এই দুই দেশ যে সারা বছর মাংস রপ্তানি করে বিশ্ব বাজারের শীর্ষে থাকে, এরা এত মাংস কই পায়? পায় প্রাণীহত্যার মাধ্যমে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বিশ্বে প্রায় ৫৬ টি মুসলিম দেশ। কেউই কিন্তু মাংস রপ্তানির শীর্ষে না।
তো, প্রাণীহত্যা কারা বেশি করে?
সে দিকে নজর না দিয়ে আপনারা ঐ কোরবানির ঈদের পেছনে লেগেছেন কেন?
উদ্দেশ্য কী?
যা হোক, ব্রাজিল ও ভারত মাংস রপ্তানির শীর্ষে। এ জন্য অনেক প্রাণী নিধন করতে হয়। এ কারণে তাদেরকে আমি দোষী ভাবি না। প্রাণী দিয়া কী করব? প্রাণী বিলুপ্ত হলে কী আর এমন হবে? পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? মানুষজাতী বিলীন হয়ে যাবে? আসুন, এ বিষয়ে একটু আলোচনা করি।
যখন কোনো প্রাকৃতিক কারণে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে, তখন তাকে ‘গণবিলুপ্তি’ বলে। ‘গণবিলুপ্তি’র সংজ্ঞাটা ভালোভাবে মনে রাখা জরুরী। গবেষণা বলছে, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ হয়েছে তার ৯৯ ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভাবতে পারেন- ৯৯ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে তবুও পৃথিবী টিকে আছে! তো, প্রাণী দিয়ে আমরা কী করব? ৯৯ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও তো পৃথিবী ঠিকঠাকই আছে।
ইতিহাসে এর আগে পাঁচটি গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। ওর্ডোভিসিয়ান, ডেভোনিয়ান, পারমিয়ান, ট্রায়াসিক এবং ক্রিটেসিয়াস। আনুমানিক ৪৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রথম গণবিলুপ্তিটি হয়েছিল। শেষটি হয় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। ট্রায়াসিক বাদে অপর চারটি গণবিলুপ্তিতেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সেসময় বিরাজমান প্রাণীদের ৭০ ভাগের অধিক। এই গণবিলুপ্তিগুলো ঘটেছে মূলত বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেই। যেমন উল্কাপাত, আগ্নেয়গিরি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ওঠানামা। তবে বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির আশংকা করছে। যা বর্তমানে ঘটে চলেছে।
‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’ নামের সংস্থার ২০১৪ সালের এক গবেষণায় উঠে আসে- গত ৪০ বছরে পৃথিবীর বন্যপ্রাণী ৫০ ভাগ কমে গেছে। গবেষণাটি থেকে আরও জানা যায়, ১৯৭০ সালের পর থেকে প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর সংখ্যা গড়ে ৬০ ভাগ কমে গেছে। শুধু আমেরিকার উপর একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, কেবল গত ২০ বছরেই আমেরিকা থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে ৯০ শতাংশ রাজা প্রজাপতি এবং ৮৭ শতাংশ ভ্রমর। প্রশান্ত মহাসাগরে টুনা মাছের উপস্থিতি কমে গেছে ৯৫ ভাগ।
তো, এই যে প্রজাপতি, ভ্রমর, টুনা মাছ, এগুলা কই গেল? কে খেয়ে ফেলেছে? কে ধ্বংস করেছে? মুসলমানরা?
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজারের মতো মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজাতি চিহ্নিত করেছে বিজ্ঞানীরা। এর মাঝে গত ৪০ বছরেই বিলুপ্ত হয়েছে ৩৩৮টি প্রজাতি। তো এগুলো কেন বিলুপ্ত হয়েছে? আর বিলুপ্তির ফলে কী এমন আহামরি সমস্যা হয়েছে শুনি? এত প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার পরও এখনো পৃথিবী টিকে আছে, মানবজাতীও বহাল-তবিয়তে আছে।
বিজ্ঞানীরা ১২ লক্ষ প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী চিহ্নিত করতে পেরেছে। সেগুলোর ৪০ ভাগই ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই বিলুপ্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে ১৫০০ প্রজাতির কেবল স্থলজ শামুকই রয়েছে। কই গেল এসব শামুক? মুসলমানরা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে?
‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’বা আইইউসিএন বলছে, প্রায় ২৬,৫০০ প্রজাতির প্রাণী শীঘ্রই বিলুপ্ত হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রাণীগুলোর মাঝে আছে উভচর প্রাণীদের ৪০ ভাগ, প্রাকৃতিকভাবে প্রবালপ্রাচীর তৈরি করা প্রবালের ৩৩ ভাগ প্রজাতি, ২৫ ভাগ স্তন্যপায়ী আর ১৪ ভাগ পাখির প্রজাতি। এগুলা বিলুপ্ত করতেছে কারা? মুসলমানরা?
১৯৯৩ সালের পর আফ্রিকান সিংহ কমে গেছে প্রায় ৬০ ভাগ। একসময় রাশিয়া আর চীনের দক্ষিণপূর্বাঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো অত্যন্ত সুন্দর আমুর চিতাবাঘ বর্তমানে ১০০টি বেঁচে আছে মাত্র! এসব সিংহ ও চিতাবাঘ গেলো কই? মুসলমানরা খেয়ে ফেলেছে? ঈদের দিন কোরবানি দিয়েছে?
প্রকৃতিতে অসংখ্য প্রাণী জন্ম নেবে এবং সেগুলো প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবী ত্যাগ করে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের কোনো অবদান না থাকলেও পৃথিবীতে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতো। এটা আমার কথা নয়। এটা বিজ্ঞানেরই কথা।
‘প্রাণীর বিলুপ্তিতে বিভিন্ন খাদ্যশৃঙ্খল পুরোপুরি ভেঙে পড়বে’—এমন একটা ধারণা বিজ্ঞান হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এই কথা বিশ্বাস করলে তো এতদিনে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যাওয়ার কথা। মানবজাতির অফুরন্ত দুর্ভিক্ষে পতিত হওয়ার কথা। কেননা, কেবল ১৫ শতকের পরবর্তী ৫০০ বছরে পৃথিবী থেকে অর্ধেক মেরুদণ্ডী প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ১৯ শতক থেকে গত ২০০ বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাণীর বিলুপ্তির হার প্রকৃতির স্বাভাবিক হারের চেয়ে ভৌগোলিক অবস্থানভেদে ১০০-১০,০০০ গুণ বেশি! তবুও তো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়নি, মানুষও বিলুপ্ত হয়নি, খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙেচুরে দুর্যোগও নামেনি।
তো ভাই রে, এত বড় পৃথিবীতে, এত এত প্রাণী বিলুপ্তির মধ্যে মুসলমানদের কোরবানির ঈদে জবাই করা প্রাণীর সংখ্যা নিতান্তই অল্প। তা ছাড়া, চার হাজার বছর ধরে ঘটে চলা এই কোরবানির ফলে গরু, মহিষ, উট, দুম্বা, ছাগল, ভেড়া কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যায় নাই।
এরপরও আপনারা অন্যসব বিষয় বাদ দিয়া লেগে থাকেন মুসলমানদের ঐ কোরবানির ঈদের পেছনেই। এর নাম দিয়েছেন পশুহত্যা উৎসব। আপনাদের উদ্দেশ্য কী, সেইটা আমরা বুঝি। কিন্তু আমরা যে আপনার উদ্দেশ্য বুইঝা ফালাইছি, সেইটা বোঝার মতো বোধশক্তি আপনার নাই। কেননা, আপনার মনের ভেতর যেই পশুটা বাস করে, সেই পশুটা আপনার ভেতরে পায়খানা করে দিয়েছে। সেই পায়খানা দিয়েই গঠিত হয়েছে আপনার মগজ।