তৃতীয় পর্ব দেখতে ক্লিক করুন এইখানে…
গ্রেনাকে বিদায় জানিয়ে ছুটে চললাম গন্তব্যের দিকে। ধীরে ধীরে গতি বেড়ে চলল। ৩০ থেকে ৫০, ৫০ থেকে ৭০, ৭০ থেকে ৯০ এভাবে। গাড়ির হাব্রিডের সিস্টেমের দিকে লক্ষ্য করছিলাম। গতি বাড়তে থাকলে হাইব্রিড থেকে অকটেনে চলে যাচ্ছে। হাইব্রিডে চললে আমার কোনও খরচ হয় না বললেই বলে। তখন গাড়ি বলে মূলত ব্যাটারির মাধ্যমে। বিশেষ এক ব্যবস্থায় অকটেন-চালিত ইঞ্জিন থেকে ব্যাটারি চারজ হয়ে থাকে। আর গাড়ি ব্রেক করলেও ব্যাটারি চারজ হয়। বলা যায় এক্সেলারেটর থেকে পা তুলে নিলেই হাইব্রিড ব্রেক কাজ করতে থাকে এবং তখন হাইব্রিড ব্যাটারি চারজ হতে থাকে। হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে টয়োটা অগ্রগামী। এসব গাড়িতে দুটো করে ইঞ্জিন থাকে। একটি হাইব্রিড ব্যাটারিতে চলে আর অন্যটি তেলের ইঞ্জিনে বলে, অর্থাৎ অকটেনে। অনেক গাড়িতে ডিজেল ইঞ্জিনও থাকে, তবে ডিজেল ইঞ্জিন আমার অপছন্দ। পরিবেশের জন্য ডিজেল খুব জঘন্য, দুর্গন্ধ ছড়ানো ছাড়াও কার্বন নির্গমনে পরিবেশ বিষাক্ত করে তোলে। এ কারণেই লক্ষ্য করবেন বাংলাদেশের রাস্তায় বের হলে দুর্গন্ধ নাকে আসে এবং চোখ জ্বলা শুরু করে। ডিজেলের গাড়িতে রোড ট্যাক্সও অনেক বেশি। আমার গাড়ির রোড ট্যাক্স মাত্র ৩৬০ ক্রোনার যা বাংলাদেশি তাকায় প্রায় ৩ হাজারের মতো।
নমুনা গাড়ী
হাই-ওয়ে ধরে আবার পূর্বের গতিতে গাড়ি চলতে লাগলো। গতিসীমা ১২০, তবে অনেকেই ড্রাইভ করছে ১৩০, ১৩৫ এমন কি ১৪০-এ। আমিও তাদের দেখাদেখি ১৩৫-এ ড্রাইভ করছিলাম। সেই একই রকম দৃষ্টি নন্দন প্রকৃতি, উঁচুনিচু পাহাড়, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে গাড়ি চলছে আর কখনো সমতল উপত্যকায় কৃষিজমিতে সোনালী ফসল নজরে পড়ছে। পূর্বে যেমন বলেছি, দক্ষিণ সুইডেনেই কৃষি জমির পরিমাণ বেশি। অন্যান্য স্থানে তা খুবই সামান্য। সেখানে প্রকৃতি, বনাঞ্চল, পাহাড় – এসবই বেশি। জুমা আদায় করে রওয়ানা করেছি। ক্রমে আসরের নামাযের সময় হয়ে এসেছে। গ্রেনায় যখন থেমেছিলাম, তখনো আসরের সময় হয়নি। এদেশে এই এক অবাক করা বিষয়। গ্রীষ্মে সূর্য অস্ত যায় প্রায় ১০টার দিকে। তাই ৬টার পূর্বে আসরের সময় হয় না। জোহরের পর থেকে আসরের সময় হতে তাই অনেক লম্বা সময়। কেউ চাইলে জোহরের পর ৮ ঘণ্টার অফিস করে আসতে পারবে।
কোথাও থেমে আসর আদায় করে নিতে চাচ্ছিলাম। এদেশে এই একটি সমস্যা, মুসলমানদের সংখ্যা কম হওয়ায় যাত্রা পথে মসজিদ পাওয়া ডুমুরের ফুলের মতোই দুষ্প্রাপ্য। তেলের পাম্পে থেমে গাড়িতে বসেই ইশারা দিয়ে নামায আদায় করে নেয়া যায়। তবে তেলের পাম্পে যেতে হলে আমাদেরকে হাই-ওয়ে থেকে নেমে শহরে যেতে হবে। একবার হাই-ওয়ে থেকে নেমে আবার উঠতে কম করে হলেও আধা ঘণ্টা সময় চলে যাবে। তাই আমি এমন একটি জায়গা খুঁজছিলাম যেখানে হাই-ওয়ে থেকে না নেমেও গাড়ি থামিয়ে নামায আদায় করা সম্ভব হয়। হাই-ওয়েতে এমন স্থান পাওয়া কঠিন। আমাদের এখানে হাই-ওয়েতে তিনটি লেইন থাকে। একেবারে বামের লেইনটি কাউকে অভারটেক করার জন্য। মধ্যখানের লেইন দিয়েই সচারাচর গাড়ি চলে। আর একেবারে ডানের লেইনটি জরুরি কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। কারো গাড়িতে সমস্যা দেখা দিলে কিংবা কাউকে অন্য কারণে থামতে হলে সেখানে থামে। তবে একেবারে ডানের লেইনে থামার শর্ত হল, গাড়ি থেকে ১০০ মিটার পূর্বে সতর্কতা-মূলক ট্রাইয়েঙ্গেল স্থাপন করতে হবে। সব গাড়িতেই এই warning triangle রাখা বাধ্যতামূলক। কাজেই নামাযের জন্য এভাবে থামা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাছাড়া এই লেইনে গাড়ি থামানো তেমন নিরাপদও নয়। একেবারে এক মিটার দূর দিয়ে ১৪০ গতিতে কোনও গাড়ি শাঁ করে চলে গেলে যে শব্দ এবং ভয়ংকর অনুভূতি হয়, তা সবাই গ্রহণ করতে পারে না। কেবল দ্রুতগামী গাড়ির চাকার শব্দেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে পারে কেউ কেউ।
স্টকহোম সিটি, সুইডেন। Image Source: democracywithoutborders.org
লক্ষ্য করলাম কয়েক কিলোমিটার পরপর পুলিশ কন্ট্রোল সাইনবোর্ড রয়েছে। সেখানেও গাড়ি থামানো যেতে পারে। তবে যখন এই সাইনবোর্ড নজরে পড়ে তখন ১৩৫ গতির গাড়ি থামানো একেবারে অসম্ভব। দ্রুতগতির একটি গাড়ি হার্ড ব্রেক করে থামালেও তা থামতে থামতে ১০০ মিটার চলে যাবে। আর সে ধরণের হার্ড ব্রেক কেবল জরুরি প্রয়োজনেই করা হয়। নামাযের জন্য থামতে তো নয়ই। বেশ কয়েক কিলোমিটার পরপর ট্রাফিক কন্ট্রোলও রয়েছে। সেগুলো আবার বেশ লম্বা এবং অনেক আগে থেকেই সংকেত দেয়া থাকে। এভাবে থামার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আমরা প্রায় আরো ৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেললাম। অবশেষে ট্রাফিক কন্ট্রোল লেখা এক জায়গায় গাড়ি থামাতে সক্ষম হলাম। জায়গাটা একেবারে নিরিবিলি। পাশে বিশাল পাহাড়। দেখে কিছু ভয় ভয় করছিল। যদিও জায়গাটা রাস্তার পাশে এবং এদেশে চোর-ডাকাতের তেমন উপদ্রব নেই, তবুও এই বিরান ভূমিতে গাড়ি থামিয়ে পরিবার নিয়ে অবস্থান করা তেমন নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। তাই গাড়িতে বসেই তাড়াতাড়ি ইশারা দিয়ে নামায আদায় করে ফেললাম। আমার পাশের সীটে সামনে আয়েশা বসেছে। দীর্ঘ যাত্রায় বাচ্চারা ঘুমাতে চাচ্ছিল। তাই ওর সীটটা পেছনে হেলান দিয়ে দিলাম।
নামায শেষ করেই আবার ছুটে চললাম পূর্বের গতিতে, ১৩৫। গাড়ি যেহেতু পুরো অটোতে চলছে, তাই হাতের কর গুণে দরুদ শরীফ পড়তে লাগলাম। মিনহাজ গোশা-ই দরুদ শরীফ গ্রুপে যুক্ত থাকায় প্রতিদিন কম পক্ষে ৩০০ বার দরুদ পাঠে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি ওয়াদা করেছি প্রতিদিন ৫০০ বার করে দরুদ শরীফ পড়বো। প্রতি নামাযের পর তাই ১০০ বার করে দরুদ পাঠ করি। চলার পথে যেহেতু তাসবীহ আনিনি, তাই হাতের কর গুণে গুনেই পাঠ করলাম।
মাঝে মাঝে বাচ্চারা জেগে উঠে আর জিজ্ঞেস করে, বাবা আমরা এখন কোথায়? আয়েশা কিছুটা বোরিং ফীল করছিল। কিছুক্ষন পরপর ও জিজ্ঞেস করছিল, আমরা কখন ফুফুর বাসায় পৌঁছবো? ফুফুকে ওরা খুব মিস করছিল। সাত-সমুদ্র তের নদীর এ পাড়ের এদেশে আত্মীয় বলতে আমার এই ছোট বোন। বাচ্চারা আজকাল ফোনে দেশের মানুষের সাথে কথা বলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে দেখতে পারে না। এই ফুফুর কাছ থেকে আদর পায়। আমার এই ছোটবোন সুইডেনে আসার পর প্রায় এক বছর আমাদের সাথে থেকেছিল। তাই বাচ্চারা ওকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। আজ প্রায় ৮ মাস হল ওরা রাজধানীতে মুভ করেছে। বাচ্চারা তাই অনেকটা উৎফুল্ল, অনেকদিন পর ফুফুর দেখা পাবে। কে ফুফুর কাছে ঘুমাবে টা নিয়েও এদের মাঝে চলছিল ঝগড়া। এরা সবাই ফুফুর কাছে ঘুমাতে পারবে বলে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছিলাম।