সূর্যের অন্যতম গ্রহ এই পৃথিবী প্রাণের ঐশ্বর্যে ভরপুর। মহাবিশ্বে সূর্যের মত হাজার হাজার নক্ষত্র আছে, আছে গ্রহ ও উপগ্রহ। পৃথিবী-ভিন্ন অন্য কোন গ্রহে বা উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের মাঝে একটি ধারণার পর্যায় হতে তুমুল অনুসন্ধানের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। জ্ঞানের যা দোষ— অনুসন্ধান ও অনুসন্ধিৎসা। অনেকের মনে তাই প্রশ্ন: ভিন্ন জ্যোতিষ্কে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনার বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে কিছু আছে কি?
আল-কুরআন:
এ প্রসঙ্গে আমরা আল-কুরআনের দু’টি আয়াত ও একটি হাদিস উল্লেখ করছি।
প্রথম আয়াত, আল্লাহ তা’আলা বলেন— ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং এগুলোর অনুরূপ পৃথিবীও; এগুলোর মাঝে তাঁর নির্দেশ নেমে আসে, যাতে তোমরা বুঝতে পারো যে, আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান; আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান দ্বারা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।’ (সুরা আল-তালাক ১২)
প্রাচীন তাফসীরকারগণ সপ্ত আকাশের অনুরূপ পৃথিবীর ব্যাখ্যায় হয়রান হয়েছেন। কারণ এককালে এই ধারণাও ছিল না যে, পৃথিবী একটি গ্রহ, অনুরূপ আরো গ্রহের ধারণা তো বহু দুরের ব্যাপার। তাই কোনো কোনো তাফসীরকার সাত পৃথিবী বলতে পৃথিবীর সাতটি স্তর বা সাত ইকলিমকে নির্দেশ করেছেন।
তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য, পূর্বসূরি তাফসীরকারদের অনেকে বলেছেন, পৃথিবীর মত আরো সাতটি পৃথিবী আছে (যামাখশারি)। তবে ওগুলোতে প্রাণীর অস্তিত্বের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না। অবশ্য আল-মাওয়ার্দি বলেছেন, ওই পৃথিবীগুলোতে মানুষ/প্রাণীরে অস্তিত্ব থাকতে পারে, তবে তাদের জন্য ইসলামের বিধান প্রযোজ্য নয়। ইসলামের বিধান কেবল পৃথিবীর জন্য প্রযোজ্য।
এই ব্যাখ্যাকে আরেকটু বিস্তৃত করা যায় এভাবে যে, আয়াতে অনুরূপ সংখ্যক পৃথিবী বলতে নির্দিষ্ট করে সাতটি পৃথিবী বুঝানো হয়নি এবং এখানে সাত সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যাবাচক নয়; বরং বহুত্বজ্ঞাপক, অর্থাৎ অনেকগুলো পৃথিবী বা পৃথিবীর মত গ্রহ আছে। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, পৃথিবীর মত বাসযোগ্য গ্রহ আছে।
দ্বিতীয় আয়াত— ‘তাঁর অন্যতম নিদর্শন হল আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এই দুইয়ের মাঝে যে সকল দাব্বাহ (জীবজন্তু) ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেগুলো। তিনি যখনই ইচ্ছা এগুলোকে সমবেত করতে সক্ষম।’ (সূরা আশ-শুরা ২৯)
প্রথমে দাব্বা শব্দের অর্থ জেনে নিই। সূরা নূরের (আয়াত ৪৫) আলোকে বলা যায়, সরীসৃপ, চতুষ্পদ জন্তু ও মানুষের মত দ্বিপদী প্রাণীকে দাব্বাহ বলা হয়। তার মানে সুরা আশ-শুরায় আল্লাহ বলেছেন, তিনি পৃথিবীতে ও আকাশমণ্ডলীতে সরীসৃপ, চতুষ্পদ ও দ্বিপদী প্রাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীতে এসব প্রাণী আছে, এটা তো চাক্ষুষ বিষয়। কিন্তু আকাশমণ্ডলীতে প্রাণী ছড়িয়ে দেয়ার মানে কি? এর মানে নিশ্চয় এটা নয় যে, হাওয়ায় প্রাণী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বরং এর অর্থ হল আকাশমণ্ডলীতে অবস্থিত পৃথিবীভিন্ন অন্যান্য জ্যোতিষ্কে আল্লাহ তাআলা প্রাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন।
ভিনগ্রহ বা ভিন্ন জ্যোতিষ্কে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনার ব্যাপারে এটি অনেক সুস্পষ্ট আয়াত। তাই অনেক তাফসীরকার এটা স্বীকার করে বলেছেন যে, পৃথিবীভিন্ন অন্য গ্রহে প্রাণী থাকতে পারে। তবে সাবুনি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ভিনগ্রহে প্রাণী থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মানুষ থাকবে না। তাঁর যুক্তি হল কুরআনের সূরা আল-আরাফের ২৯ সংখ্যক আয়াত— ‘সেখানেই তোমরা জীবনযাপন করবে, সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে এবং তথা হতে তোমাদেরকে বের করে আনা হবে।’
আল-হাদিস:
ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, সাতটি পৃথিবী আছে, প্রতিটিতে তোমাদের মত নবী আছেন, তাদেরও নূহ আছেন যেমন তোমাদের ছিল, তাদেরও ঈসা ও ইবরাহিম আছেন।
এ হাদিসকে দুর্বল বলে মনে করা হয়। কিন্তু আয়াতের অর্থের সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় হাদিসটি উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া আরেকটি ব্যাখ্যা দিলে সকল সংশয় দূর হয়। এ হাদিসে নূহ, ইবরাহিম ও ঈসা (আ:) এর উল্লেখ রূপকভাবে করা হয়েছে। অর্থাৎ ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের আদিপিতা আছে, যেমন পৃথিবীবাসীর জন্য ছিলেন আদম। পৃথিবীতে যেমনি ইবরাহিম, নুহ ও ঈসা (আ) এর বিশিষ্টজন ছিলেন, তেমনি তাদেরও বিশিষ্টজন থাকবে। অর্থাৎ ইবন আব্বাসের উক্তির অর্থ এই নয় যে, ওই গ্রহগুলোতে মানুষই থাকেবে বা একেবারে হুবহু আদম, ইবরাহিম ও নূহ থাকবেন, বরং তাঁর কথার অর্থ হল, সেগুলোতে প্রাণী থাকবে, তাদেরও আদিজন থাকবে, বংশ পরম্পরা থাকবে, বিশিষ্টজন থাকবে।
আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে এই ব্যাখ্যা বোধগম্য বলে মনে হয়। চিন্তা করুন! ১৪০০ বছর আগে এহেন কথা বললে মানুষ পাগল ছাড়া আর কিছু বলত কি? তাই ইবন আব্বাস প্রথমে এই তাফসির করতে চাননি, তিনি বলেছিলেন, আমি যদি এ আয়াতের তাফসীর বলি তোমরা অস্বীকার করবে (তাবারী ২৮: ৭৮)। পরে অনুসারীদের পীড়াপীড়িতে তিনি তাফসীর করেছিলেন। এ ব্যাপারে আরো কিছু হাদিস উল্লেখ করা যায়। লেখা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে উল্লেখ করলাম না।
অতএব আমরা বলতে পারি, কুরআন ও হাদিসে এই ইঙ্গিত আছে যে, পৃথিবীর বাইরে ভিন্ন গ্রহ বা উপগ্রহ বা জ্যোতিষ্কে প্রাণী থাকতে পারে।
(পুনশ্চ: থাকতে পারে এবং থাকবেই— এক বিষয় নয়)
লেখক: ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক,
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।