বায়োফ্লক মাছ চাষে সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি হতে পারে সঠিক পরিকল্পনা করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন দিন কি করবেন তার একটা complete SOP তৈরী করা। SOP মানে হচ্ছে Standerd Operating. Procedure. ট্যাংক প্রস্তুতি থেকে শুরু করে একেবারে হারভেষ্ট পর্যন্ত কোন দিন কি করবেন তার একটা বিস্তারিত বর্ননা পাওয়া যাবে এখানে।
Day Wise Activity হিসেবে বায়োফ্লক মনোসেক্স তেলাপিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজগুলিকে কয়েকটি বিভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
যেমন – ট্যাংক প্রস্তুতি,
পানি প্রস্তুতি,
FCO তৈরী,
মাছের পোনা সংগ্রহ,
মাছের পোনা রোগ জীবানু মুক্ত করন,
পোনা ট্যাংকে অবমুক্তকরন,
ট্যংকের পানি নিয়মিত পরীক্ষা,
মাছের খাবার এবং CN ratio প্রস্তুতি,
মাছের রোগ এবং বৃদ্ধি পরীক্ষা,
হারভেষ্টিং।
উপরের সবগুলো বিষয় একটি SOP তে বিস্তারিত থাকবে দিন অনুসারে। একটি দশ হাজার লিটার ট্যাংকের প্রয়োজনীয় সকল উপকরন সংগ্রহ করে রাখতে হবে যাতে যে কোন প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে পাওয়া যায়।
বায়োফ্লক চাষের প্রথম দিনে দুটি কাজ পাশাপাশি করতে হবে, তাতে করে ২ – ৩ দিন সময় বেচে যাবে। একটি হচ্ছে ট্যাংকের পানির জন্য ও মাছের খাবারের জন্য FCO তৈরী এবং অন্যটি হচ্ছে ট্যাংক পরিস্কার করে রোদে শুকানো।
বায়োফ্লক টেঙ্ক, Image Source: amazon.in
এর জন্য দুইটা ১০০ লিটার ড্রাম নিতে হবে যার একটিতে এয়ারেশন দিয়ে FCO তৈরী করব সরাসরি চাষ ট্যাংকে দেবার জন্য এবং অপরটিতে এয়ারেশন ছাড়া FCO তৈরী করব যা মাছের ভাস্মান খাবারে ব্যবহার করা হবে। প্রয়োজনীয় উপকরন লাগবে ফ্রেশ ২০০ লিটার পানি, চিনি, কলা, আনারস, মোলাসেস, ভিটামিন বি ও সি ট্যাবলেট, ইয়ালকুট, প্রোবায়োটিক পাউডার, ঈষ্ট ট্যাবলেট, ব্রেড ঈষ্ট এবং ডিম। এখন পানির জন্য FCO তৈরীর জন্য প্রথমে ১০০ লিটার ফ্রেশ পানি নিয়ে তাতে ৩ কেজি চিনি, ৩৫ বোতল ইয়াল্কুট বোতল এয়ারেশন সহ ১০০ লিটারে ড্রামে দিয়ে দিতে হবে। এরপর ১৫ পিস কলা, ১ পিস আনারস, ৭ পিস ভিটামিন বি ট্যাবলেট, ৭ পিস ভিটামিন সি ট্যাবলেট, ১২ পিস ঈষ্ট ট্যাবলেট ব্লেন্ডার করে সমান ভাবে মিশাতে হবে। এই মিশ্রিত ব্লেন্ডার উপাদান টি ১৪ টা ডিমের একটি গামলায় সমানভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এই মেশানো দ্রবন টি ১০০ লিটার ড্রামে ধীরে ধীরে ঢেলে দিতে হবে। এরপর ২৫০ গ্রাম প্রোবায়োটিক পাউডার ও ২০ গ্রাম ব্রেড ঈষ্ট পানিতে আলাদা ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর ড্রাম টি ভাল করে এয়ার টাইট দিয়ে ৭ দিন ইনকিউবেশনে রাখতে হবে। পাশাপাশি আমাদের আরো একটি ১০০ লিটার ড্রামে এয়ারেশন ছাড়া FCO তৈরী করতে হবে। এজন্য ড্রামে ১০০ লিটার ফ্রেশ পানি দিয়ে তাতে ৩৫ বোতল ইয়াল্কুট এবং ৫ লিটার মোলাসেস মিশিয়ে দিতে হবে। এরপরে আগের মত ডিম সহকারে ব্লেনডার মিশ্রন এই ড্রামে দিয়ে দিতে হবে। ব্লেন্ডার মিশ্রন দেবার পর ২৫০ গ্রাম প্রোবায়োটিক পাউডার ও ২০ গ্রাম ব্রেড ঈষ্ট দিতে হবে।এরপর ভাল ভাবে এয়ার টাইট দিয়ে এয়ারেশন ছাড়া ৭ দিন ইনকিউবেশনে রাখতে হবে।
দ্বীতিয় কাজটি হচ্ছে সাবান অথবা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ট্যাংক ভাল পরিস্কার করে ধুয়ে ১ দিন রোদে শুকাতে হবে।
বিভিন্ন source থেকে যেমন নলকূপ, নদী, পুকুর বা বড় জলাশয় এর পানি আয়রন পরীক্ষা করতে হবে। পানিতে আয়রন 0.1-0.2mg/L এর বেশি থাকলে তা দূর করতে হবে ফিল্টার এর মাধ্যমে।ফিল্টার করার দুটি সহজ পদ্ধতি আছে
প্রথম পদ্ধতিঃ ১০ টনের ট্যাংকে ৫০০ গ্রাম ফিটকারি দিয়ে ২৪ – ৩৬ ঘন্টা এয়ারেশন দিয়ে ৪ – ৫ ঘন্টা এয়ারেশন বন্ধ রাখলে আয়রনের ময়লা ট্যাংকির নিচে জমা হয়ে যায় এবং পুরো ট্যাংকির পানি স্বচ্ছ হয়ে যায়, এবং উপর থেকে ফ্রেশ পানি চাষ ট্যাংকে সরিয়ে নিতে হবে। এয়ারেশন দিতে হবে চারটি ডট বা ন্যানো টিউব পয়েন্টের মাধ্যমে।
আয়রন টেস্ট কীট, Image Source: gapswater.co.uk
দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ ১০ টনের ট্যাংকে ১০ গ্রাম ডাই সোডিয়াম ইডিটিএ দিয়ে ২৪ ঘন্টা এয়ারেশন দিতে হবে এবং উপর থেকে ফ্রেশ পানি চাষ ট্যাংকে সরিয়ে নিতে হবে। অথবা ট্যাঙ্ক বেশি না থাকলে নিচ থেকে জমা আয়রন আউটলেট দিয়ে বের করা যায়।
আমাদের কাছে এখন আয়রন মুক্ত পানি রয়েছে যা জীবানু মুক্ত বায়োফ্লোক ট্যাংকে দিয়েছিলাম পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার জন্য । তৃতীয় দিনে আমরা পানির প্যারামিটার চেক করব।
প্রথমেই দেখব পানির Ph 7.5 -8.5 এর মধ্য আছে কি না। যদি এর থেকে কম হয় তাহলে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3) দিব এক কেজি প্রতি দশ হাজার লিটার ট্যাংকের জন্য। বেশি হবার সম্ভাবনা নেই তবুও যদি হয় তাহলে তেতুল পানিতে গুলিয়ে দিব।
এরপর দেখব পানির salinity কত রাখলে মনোসেক্স তেলাপিয়ার বায়োফ্লোক চাষে maximum growth পাওয়া যাবে। দেখা গেছে 5 ppt salinity রাখতে পারলে তেলাপিয়ার জন্য ভাল Production পাওয়া যায় । কিন্তু শুরুর দিকে মাছের পোনা এই salinity সহ্য করতে নাও পারে এবং পোনা মারা যাবার পরিমান বেড়ে যেতে পারে। তাই ভাল উপায় হচ্ছে মাছের পোনা যেখান থেকে সংগ্রহ করা হবে সেখানকার salinity ট্যাংকে সেট করে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বাড়ানো। এখানে বলা প্রয়োজন অনেকে TDS প্যারামিটার কে বেশি গুরুত্ব দেয় যা আসলে নিস্প্রয়োজন। পানিতে সকল ধরনের দ্রবীভুত পদার্থ কে একত্রে TDS দিয়ে পরিমাপ করা হয়। অপরদিকে শুধুমাত্র দ্রবীভুত লবন কে পরিমাপ করার জন্য salinity পরিমাপ করা হয়। এবং এটাই মাছের জন্য খুব বেশি দরকার। salinity কম হলে প্রতি হাজার লিটারে ১.৭ কেজি হিসেবে ১০ হাজার লিটারে মোট ১৭ কেজি কাচা লবন ধীরে ধীরে দিয়ে আবার নতুন করে পরিমাপ করে দেখতে হবে।
TDS Meter
তারপর আমরা দেখব পানির DO মানে পানিতে দ্রবীভুতন অক্সিজেন এর পরিমান হতে হবে প্রতি লিটারে ৫.৬ mg.
DO Meter, Image Source:intl.hannainst.com
এভাবে চারদিন এয়ারেশন দিয়ে রাখতে হবে।
এই দিনে আপনাকে দুটি কাজ করতে হবে। একটি হচ্ছে ট্যাংকে মোলাসেস দেয়া এবং অপরটি হচ্ছে ফচো প্রয়োগ করা। ড্রামে FCO তৈরী করার জন্য ৭ দিন ইনকিউবেশন এ রাখা হয়েছিল, যার একটি ট্যাংক এর পানির জন্য, অপরটি মাছের খাবারের জন্য।
প্রথমে প্রতি হাজার লিটারে ১০০ml হিসেবে ১০ হাজার লিটার পানিতে ১ কেজি মোলাসেস মিশাতে হবে। এরপরে আমরা FCO দিব কিন্তু দেয়ার আগে FCO হয়েছে কি না তা চেক করতে হবে। সঠিক ভাবে FCO হয়েছে কি না এটা বুঝার উপায় হল মদের মত মিষ্টি গন্ধ বের হবে, পানির রং হবে বাদামী এবং Ph কমে গিয়ে ৪-৫ এর মধ্যে থাকবে। এবার প্রতি হাজার লিটার ১০০ml হিসেবে ১০ হাজার লিটার পানির জন্য ১ লিটার FCO ভাল করে সমান ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।।
মোলাসেস, Image Source: medicalnewstoday.com
এই দিন পানির প্যারামিটার গুলি আবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে যেমন DO 5.6 mg/L, Ph 7.5-8.5, salinity 1 ppt অথবা মাছের পোনা যেই পানিতে ছিল তার Salinity,
PH Meter, Image Source:bgb-info.com
তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ইত্যাদি। যদি এগুলি ঠিক থাকে তাহলে মাছ ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। আর যদি প্যারামিটার গুলি ঠিক না থাকে তাহলে উপরিল্লিখিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
নবম দিনে মাছের পোনা ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সুস্থ এবং উন্নত জাতের পোনা সংগ্রহ করতে হবে। মনোসেক্স তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে যেই সব হ্যাচারিতে পোনাগুলি হ্যাপাতে নার্সারি করা হয় এবং নিয়মিত হরমোন দেয়স হয় সেখান থেকেই সংরহ করা উচি। মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা সাধারনত একটু ছোট হয়ে থাকে।
প্রতি কেজিতে ৪ টা টার্গেট ধরে ৫০০ কেজি তেলাপিয়া হারভেষ্ট করতে হলে মিনিমাম ৩০০০ পিস পোনা ছাড়তে হবে। ৫০০ থেকে ১০০০ লাইনের পোনা হলে ভাল হয় বায়োফ্লকের জন্য। পরিবহন করতে হবে রাতের বেলায় এনং পোনা ট্যাংকে অবমুক্ত করতে হবে সকাল ভোরে অথবা পড়ন্ত বিকেলে। পোনা সরাসরি চাষ ট্যাংক না দিয়ে তাপমাত্রার সামঞ্জস্য রাখার জন্য ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পলিথিন ব্যাগ সহকারে ট্যাংকে দিতে হবে। এরপর সবগুলো পলিথিন ব্যাগ উঠিয়ে জীবানুনাশক দ্রবনে ২ থেকে ৩ বার চুবিয়ে জীবানুমুক্ত করতে হবে। জীবানুনাশক হিসেবে পটাশিয়াম পারম্যংগানেট এবং কাচা লবনের দ্রবন ব্যবহার করব। ট্যাংক থেকে ২০ লিটার করে পানি নিয়ে দুটি গামলায় রাখব এবং একটি তে এক চামচ পটাশ ও অপরটিতে ২০ গ্রাম কাচা লবন ভাল করে মিশিয়ে দিব। এবার পলিব্যাগ থেকে পোনা নিয়ে পটাশের দ্রবনে তিন বার চুবিয়ে লবন পানি দিয়ে পরিস্কার করে নিব। এরপর পোনা গুলি ধীরে ধীরে ট্যংকে ছেড়ে দিব। প্রথম দিন কোন রকম খাবার দেয়া যাবে না।
এই দিন থেকে মাছের ওজনের ৩% খাবার দিতে হবে। দিনে দুই বেলা খাবার দেয়া যাবে। মাছের খাবারে প্রোটিনের উৎস থাকতে হবে ৩০-৪০%। এই খাবার দেয়ার আগে কিছুটা প্রস্তুত করে নিতে হবে।
প্রতি ৪ কেজি খাবারের জন্য এয়ারেশন ছাড়া ড্রাম থেকে ১০০ ml FCO নিতে হবে। এই পরিমান FCO এর সাথে ১ লিটার পানি দিয়ে মিশ্রন তৈরী করতে হবে। মিশ্রনটি মাছের খাবারের সাথে ভাল ভাবে মিশিয়ে এয়ার টাইট ড্রামে রেখে দিতে হবে। পরবর্তীতে এই খাবার মাছ কে দিতে হবে।
মাছের খাবার দেয়ার পর থেকে প্রতি দিন ট্যাংক মনিটরিং করতে হবে।এর পাশা পাশি প্রতি সপ্তাহে কিছু বিশেষ কাজ করতে হবে।
প্রথমে প্রতি হাজার লিটার এর জন্য ৬৬ গ্রাম লাইম বা CaCo3 হিসেবে ১০ হাজার লিটার ট্যাংকে ৬৬০ গ্রাম লাইম ট্যাংকের পানি দিয়ে দ্রবন তৈরী করে সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর ২৪ ঘন্টা সময় দিতে হবে। এই সময় পার হলে প্রতি হাজার লিটার 50 ml মোলাসেস দিতে হবে। ১০ হাজার লিটার এর জন্য প্রায় ৫০০ গ্রাম মোলাসেস সমান ভাবে চারদিকে ছিটিয়ে দিতে হবে। একই ভাবে এয়ারেশন দেয়া ড্রাম থেকে প্রতি 10 হাজার লিটারে ৫০০ ml FCO ভাল ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। Water Sampling করে দেখতে হবে flock এর পরিমান ঠিক আছে কি না। এক্ষেত্রে ইমহফ কোনে প্রতি লিটার স্যাম্পলে ৬০ ml ফ্লোক থাকা ভাল।
১০ থেকে ১৫% ট্যাংকের পানি আউটলেট দিয়ে ড্রেনেজ করে দিতে হবে।