কুরবানি:
-নির্দিষ্ট দিনসমূহে সম্পদশালীদের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাকে কুরবানি বলে।
কুরবানি কার উপর ওয়াজিব:
-যার কাছে অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থান বাদ দিয়ে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা অথবা তৎসম নগদ টাকা আছে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।
-কুরবানি’র ক্ষেত্রে এই সম্পদ যাকাতের মতো এক বৎসর নিজের মালিকানায় থাকা শর্ত নয়। বরং কেউ যদি কুরবানি দিনসমূহের ফযর বেলায়ও ভাগ্যক্রমে সম্পদশালী হয়ে যায়, তখনও কুরবানি করা ওয়াজিব হবে।
-নাবালেগ ও পাগলের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। সুতরাং তাদের সম্পদ থেকে কুরবানি করা কোনোভাবে জায়িয হবে না। তবে কোনো অভিভাবক যদি নাবালেগ বা পাগলের পক্ষ থেকে কুরবানি করতে চাই, নিজের সম্পদ থেকে করতে পারে।
-সম্পদ যার মালিকানায় রয়েছে কুরবানি তার উপরই ওয়াজিব। শুধু একভাগ কুরবানি করলে উক্ত ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। পরিবারে সকল সদস্যের নামে কুরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে তিনি যদি ইচ্ছে করেন, নিজের নামে কুরবানির পাশাপাশি অন্য কারো নামে দিলেও সাওয়াব পাবে।
-কেউ যদি মৃত মা-বাবা বা অন্য কারো জন্যও কুরবানি দিতে চাই, দিতে পারবে।
কুরবানি’র সময়:
-১০ জিলহজ ঈদুল আযহা নামাযের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কুরবানির সময় থাকে। তবে প্রথম দিন করা উত্তম ও রাতে করা মাকরূহ।
-কেউ পশু যবেহের পর যদি জানেন যে, নামায শুদ্ধ হয়নি; কুরবানি হয়ে যাবে। পূণরায় পশু যবেহ করতে হবে না।
ক্স কোনো ধনী লোক কুরবানির জন্য ক্রয়কৃত পশু নির্দিষ্ট সময়ে যবেহ করতে পারেনি, এমতাবস্থায় ওই পশু কোনো গরিবকে সম্পূর্ণ সদকা করে দিবে। যবেহ করে ফেললে সব গোশত সদকা করে দিবে। নিজে খেতে পারবে না। ভুলে যদি কোনো গোশত খেয়েও থাকে তাহলে সমপরিমাণ মূল্য সদকা দিয়ে দেবে।
কুরবানি’র পশু:
-উট, গরু, মহিষ, ছাগল ও দুম্বা এই ছয় প্রকার গৃহপালিত প্রাণী ছাড়া অন্য কোনো পশু দিয়ে কুরবানি জায়িয হবে না। টারকি, হরিণ, গয়াল ইত্যাদি দিয়ে কুরবানি করা যাবে না।
-উটের বয়স ৫ বছর। গরু ও মহিষ ২ বছর হওয়া জরুরি। ছাগল, দুম্বা ও ভেঁড়া ১ বছর হতে হবে। তবে দুম্বা ও ভেঁড়া যদি নির্ধারিত বয়সের কম হওয়া সত্বেও শারীরিকভাবে সবল ও পূর্ণ ১ বছর বয়স্ক বুঝা যায় তাহলেও কুরবানি’র জন্য যবেহ করা যাবে।
-উট, গরু ও মহিষ সাত ভাগ ও ছাগল-ভেঁড়া এক অংশ হিসেব করতে হবে। শরিকি কুরবানির ক্ষেত্রে সবার নিয়ত কুরবানি হতে হবে। কেউ যদি গোশত খাওয়ার নিয়ত করে পশুতে অংশ নেয়, তবে কারো কুরবানিই হবে না।
-কুরবানি’র পশু হতে হবে সুন্দর ও সবল। দূর্বল-ক্ষীণকায়া ও দোষ-ত্রুটিযুক্ত রোগাক্রান্ত পশু দিয়ে কুরবানি করা জায়িয নেই। তবে জন্মগত কারনে যদি কোনো পশুর শিঙ না থাকে অথবা কোনো কারনে শিঙ ভেঙে যায় কুরবানি হবে; শিঙ যদি তুলে ফেলা হয় তবে জায়িয হবে না।
-কুরবানি’র জন্য ক্রয়কৃত পশু থেকে কোনো উপকার গ্রহণ করা জায়িয নেই। দুধ দোহন করাও নিষেধ। কেউ যদি ভুলে দুধ পান করে থাকে তবে তৎসম অর্থ সদকা করে দিতে হবে।
কুরবানি পশু যবেহের নিয়ম:
-কুরবানি পশু নিজে যবেহ করা মুস্তাহাব। আর নিজে যদি যবেহ করতে না পারে তবে পাশে থাকা উত্তম।
-যবেহের পূর্বে ছুরি ভালো করে ধার দিতে হবে। অতঃপর পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে ও পেছনটা উত্তর দিকে দিয়ে কিবলামুখি করে শুয়াতে হবে। আর নিচের দোয়াটি জানা থাকলে পড়বে-
‘ইন্নি ওয়াযহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বা হানিফাঁও ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়ামা হাইয়া-আ ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’
বলে যবেহ শুরু করতে হবে। শরিকদের নাম উল্লেখ না করলেও সমস্যা নেই। তবে যবেহের পর নামগুলো স্বরণ করা ভালো।
-যবেহের সময় যদি ভুলে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া না হয় পশু হালাল হবে; ইচ্ছেকৃত কেউ যদি আল্লাহর নাম বাদ দিয়ে যবেহ করে তখন তা খাওয়া হারাম হয়ে যাবে।
-কোনো কারনে পশুর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কুরবানি হবে। তবে এ রকম করা মাকরূহ। যবেহকারীকে এ ব্যপারে সতর্ক থাকতে হবে।
কুরবানি পশুর চামড়া:
-কুরবানি পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারে। অন্যথায় ক্রয় মূল্য সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। গরিব-মিসকিন বিশেষ করে এতিমখানায় দ্বীনি ইলম অর্জনেরত শিক্ষার্থীদের জন্য পুরো চামড়া কিংবা ক্রয় মূল্য উৎসর্গ করে দেয়া সবচেয়ে উত্তম।
-চামড়ার টাকা দিয়ে রাস্তা-ঘাট, মাসজিদ-মাদরাসা ইত্যাদি নির্মাণ করা জায়িয নেই। এমনকি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়াও না-জায়িয।
-চামড়া বিক্রির মূল্য দ্বারা যবেহের কাজে অংশগ্রহণকারী কারো বেতন বা পারিশ্রমিক দেয়াও জায়িয নাই।
কুরবানি গোশত:
-শরিকি কুরবানিতে গোশত বন্টনের সময় পাল্লা দিয়ে সমানভাবে পরিমাপ করে বন্টন করতে হবে। অনুমান করে বন্টন করা না-জায়িয।
-গোশত তিনভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব। নিজে, আতœীয়-স্বজন ও প্রতিবেশি এই নিয়মে বন্টন করা সৌভাগ্যের ব্যপার। তবে কুরবানি দাতা গরিব হলে সব রেখে দিতেও কোনো নিষেধ নেই।
ক্স কুরবানির গোশত যতোদিন সম্ভব রাখা যায়। তিন দিনের বেশি রাখা যায় না; এ জাতীয় কথা কুসংস্কার মাত্র।
কুরবানি দিনসমূহের আমল:
-জিলহজের ১ তারিখ থেকে কুরবানি’র পশু যবেহের পূর্ব পর্যন্ত শরীরের নখ, চুল-লোম ইত্যাদি না কাটা মুস্তাহাব। বিশেষত: যারা কুরবানি করে না, তাদের উচিত যবেহের পরই যেন শরীরে খুর দেয়া হয়, যেহেতু তারা পশু যবেহ করছে না।
কুরবানি দিনসমূহে রোযা:
-জিলহজ মাসের ১ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত অনেক ফযিলাত পূর্ণ দিন। এই দিনের রাতসমূহ প্রতিটি শবে ক্বদরের মতো মর্যাদাসম্পন্ন।
-এই মাসের ১ তারিখ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত রোযা রাখা অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ। বিশেষত: ৯ তারিখ রোযার ব্যপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন- যারা জিলহজের ৯ তারিখ রোযা রাখবে তাদের আগে-পরের এক বৎসরের গুনাহ আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেবেন।
তাকবিরে তাশরিক:
-‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া-লিল্লাহিল হামদ’ এটি তাকবিরে তাশরিক।
-জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফযর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতি ফরয নামাযের পর নারী-পুরুষ সকলে ১ বার তাকবিরে বলা ওয়াজিব। মাসজিদে ইমাম সাহেব বলতে ভুলে গেলে মুকতাদিরা বড়ো আওয়াযে বলে দিবে।
-উভয় ঈদে তাকবিরে তাশরিক পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। ঈদুল ফিত্বারে ছোটো আওয়াযে ও ঈদুল আযহাতে উচ্চ আওয়াযে।
-এই দিনসমূহে নামায কাযা হলে কাযা আদায়কালেও ফরয শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাকবির বলতে হবে।
কুরবানি’র দিন করণীয়:
-কুরবানি’র দিন তাকবির বলতে বলতে কিছু না খেয়ে ঈদুল আযহা নামায আদায় করতে যাওয়া সুন্নাত।
-ধৈর্য বা একনিষ্ঠতার সাথে কুরবানি’র কাজ সম্পাদন করতে হবে। যবেহের জন্য অস্থির হওয়া অনুচিত। যবেহকৃত পশুর রক্ত-বর্জ্য ইত্যাদি মাটিতে ফুঁতে ফেলতে হবে।
আকিকার মাস‘আলা:
-আকিকা ছেলে-মেয়ে জন্মের শুকরিয়া স্বরূপ করা হয়। অধিকাংশের মতে, সামর্থবানদের জন্য এটি সুন্নাত। আকিকা ছেলে হলে দু ভাগ ও মেয়ে হলে এক ভাগ করতে হবে। ছাগল দিলেও যথাক্রমে ছেলে হলে দুটি আর মেয়ে হলে একটি।
ক্স কুরবানির সাথে আকিকা করা যায়। কুরবানি ও আকিকার হুকুম প্রায় এক।
-আকিকার গোশত সবাই খেতে পারে। বাবা-মা এমনকি নিজে খেতেও কোনো অসুবিধা নেই।
____________________
(কুরবানির ইতিহাস ও প্রয়োজনীয় মাস‘আলা-মাসায়িল সম্পর্কে
আরো বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত-
‘‘হুসনুল বয়ান মিনাল কুর‘আনি ওয়াস সুনান’’
কিতাবটিও অধ্যায়ন করা যেতে পারে।)