(১) আলিফ লাম মীম। (২) রোমানরা পরাজিত হয়েছে (৩) নিকটবর্তী ভূমিতে; কিন্তু তারা এই পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে (৪) কয়েক বছরের মাঝে।
সুরা আল-রূমের দ্বিতীয় আয়াতে বর্ণিত রোম শব্দের অনেক রোমাঞ্চকর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বলছেন এর মানে ইটালি, আবার কেউ বলছে এর মানে হল ইটালির রাজধানী রোম। দুই ব্যাখ্যার সাথেই করোনাকে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। অনেক জ্ঞানীর পোস্টেও এমন স্থুল ব্যাখ্যা দেখা যাচ্ছে। এটি হয়ত কালিক অস্থিরতা। ইতিহাস ও তাফসির একসাথে উপস্থাপন করছি।
বর্তমান ইটালির রাজধানী রোমকে কেন্দ্র করে একাকালে বিশাল ও প্রতাপশালী একটি সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেছিল। লম্বা কাহিনী। জুলিয়াস সিজার রোমের সিনেটের ক্ষমতা খর্ব করে সম্রাট হতে পারেননি। পরে অগাস্টাস সিজার ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক বড় ভূখণ্ডজুড়ে ছিল এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খ্রিস্টান সম্রাট কন্সট্যান্টাইন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তর করে রোম হতে বাইজেন্টিয়াম শহরে নিয়ে আসেন। সংস্কারের পর সম্রাটের নামে বাইজেন্টিয়াম শহরের নতুন নাম দেয়া হয় কন্সট্যান্টিনোপল।
সাম্রাজ্যের বিশালতার কারণে সম্রাট কন্সট্যান্টাইন তার সাম্রাজ্যকে দুই ভাগ করে দুই পুত্রের মাঝে বণ্টন করে দেন: পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য, যার রাজধানী ছিল রোম শহর, পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, যার রাজধানী ছিল কন্সট্যান্টিনোপল।
Constantinople, Image Source: history.com
কিন্তু অচিরেই আসল রোমান সাম্রাজ্য তথা পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে)। কিন্তু পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য টিকেছিল আরো প্রায় এক হাজার বছর, (১৪৫৩ সাল পর্যন্ত)। অর্থাৎ কুরআন নাযিল হওয়ার সময় রোমকেন্দ্রিক রোমান সাম্রাজ্যের কোন অস্তিত্ব ছিল না। কন্সট্যান্টিনোপলকেন্দ্রিক পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য তখনও বিদ্যমান। তবে এই সাম্রাজ্যের আরেকটি নাম চালু হয়ে যায়: বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, কারণ এটির রাজধানী শহরের পুরনো নাম ছিল বাইজেন্টিয়াম।
তবে আরবরা এসব ভাগাভাগিতে কান দিত না। তারা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে রোমান সাম্রাজ্য নামেই চিনত। এজন্য কুনিয়ার বাসিন্দা মৌলানা জালালুদ্দিনকে রূমী বলা হয়, এমন নয় যে, তার বাড়ি ছিল রোমে।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবদ্দশায় পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের মাঝে যুদ্ধ লেগেই থাকত। এক পর্যায়ে পারসিকরা অব্যাহতভাবে জয় পেতে থাকে। ৬১৩ সালে পারসিকরা দামেশক দখল করে নেয়, ৬১৪ সালে জেরুসালেম ও ৬১৫-১৬ সালে মিশর দখল করে নেয়। এমনকি তারা কন্সট্যান্টিনোপল অবরোধও করে। এই সূরা যখন নাযিল হয়, হিজরতের সাত বছর আগে, তখন পারসিকদের জয়জয়কার। মক্কার কুরাইশরা উল্লসিত, মুসলমানরা বিষণ্ণ; পারসিক ও রোমানদের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমানদের সমর্থন করত, কারণ তারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করত, তাঁদের নবি ঈসা (আ)। পক্ষান্তরে কুরাইশরা পারসিকদের সমর্থন করত। পারসিকদের বিজয়ে কুরাইশরা উল্লসিত হয়। তখন মুসলমানদের সান্ত্বনা দিয়ে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়।
এখানে কুরআনের মুজিযাও রয়েছে। বলা হয়েছে রোমানরা অচিরেই বিজয়ী হবে। সূরা রূম নাযিল হওয়ার ৬ বা ৭ বছর পর ঠিকই ৬২২ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস তারসুসের যুদ্ধে পারসিকদের পরাজিত করেন। কুরআন যে আল্লাহর বাণী, তা প্রমাণিত হল।
সারকথা: সূরা রূমে উল্লেখিত ‘রোমানরা’ বলতে কন্সট্যান্টিনোপল-কেন্দ্রিক পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বোঝানো হয়েছে। ইটালিও বোঝানো হয়নি, ওই দেশের রাজধানী শহর রোমও বোঝানো হয়নি।
পুনশ্চ: সেই কন্সট্যান্টিনোপল শহর উসমানি তুর্কিরা দখল করে নেয় ১৪৫৩ সালে। তাই বিজয়ী সুলতান মুহাম্মদকে ফাতিহ বলা হয়। বিলীন হয়ে যায় হাজারবর্ষী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। বাইজেন্টিয়াম শহরের নাম আবারো পরিবর্তিত হয়, নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল, এটি এখন খ্রিস্টানদের শহরও নয়, রোমানদেরও নয়। ১৪৫৩ সাল থেকে ১৯২২ পর্যন্ত এটি ছিল উসমানি সালতানাতের রাজধানী।
লেখক: ড. যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।